বাইরে সুনসান অন্ধকার। প্রায় কিছুই দেখা যায় না। এর মধ্যেই হুডি পরা একটা লোক মোটরবাইকে হুশ করে বেরিয়ে যায়। জানা যায়, এক নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটেছে। খুনি শুধু খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি, কেটে নিয়েছে হতভাগ্য তরুণীর মাথা। মেয়েটির নাম এশা (পূজা ক্রুজ)। সে ছিল নার্সিং কলেজের ছাত্রী।এশার মৃতদেহটা যেদিন খুঁজে পায় পুলিশ, সেদিনই গোয়েন্দা বিভাগ থেকে মফস্সলের ওই থানায় বদলি হয়ে আসেন লীনা। এসেই জটিল এই হত্যা-রহস্যের মুখোমুখি হন। ক্লু ধরে রহস্যের জট খুলতে মাঠে নামেন লীনা। শুরুতে জানা যায়, ৩৯ বার স্ক্রু দিয়ে হার্টে আঘাত করে এশাকে হত্যা করা হয়েছে। মূল সন্দেহভাজন আবার মোটর মেকানিক। তবে যাদের দিকে সন্দেহের তির, তারাই কি প্রকৃত খুনি? নাকি ঘটনার পেছনে রয়েছে মনোবিকারগ্রস্ত ভয়ংকর এক ঠান্ডা মাথার খুনি?
‘এশা মার্ডার: কর্মফল’ মার্ডার-মিস্ট্রি ঘরানার সিনেমা। খুনের ঘটনার তদন্ত নিয়ে সিনেমা নতুন নয়। তবে এ সিনেমায় গল্প যেভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, নিঃসন্দেহে তা ঢাকাই সিনেমায় মার্ডার-মিস্ট্রি ঘরানার উদাহরণ হয়ে থাকবে। প্রথমেই আসা যাক সিনেমার উপস্থাপনে। এই সিনেমায় বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাশব্যাকে কয়েকটি টুকরা টুকরা গল্প দেখানো হয়েছে। এই গল্পগুলো থেকে ভিন্ন ভিন্ন দুটি অতীতের ইঙ্গিত পান দর্শক। কিন্তু রহস্যের এই জট খুলতে অপেক্ষা করে থাকতে হয় শেষ দৃশ্য পর্যন্ত।ছবিতে তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তা লিনার চরিত্রটি করেছেন আজমেরী হক বাঁধন। ডার্ক থিমের সিনেমায় নন গ্ল্যামারাস চরিত্রটি তিনি দারুণভাবে তুলে ধরেছেন। ‘রেহানা মরিয়ম নূর’-এর পর এ সিনেমা দিয়েই বড় পর্দায় ফিরলেন বাঁধন। আর ফেরাটা হলো ফেরার মতোই। পুলিশ কর্মকর্তা লীনার চরিত্র তিনি এত ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন যে পূর্ণ নম্বর পাবেন তিনি। তাড়া করে বেড়ানো অতীত, কর্মক্ষেত্রে একের পর এক প্রতিকূলতা, বসের পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব, বিশ্বাসভঙ্গ এবং শেষ দিকে হ্যান্ড টু হ্যান্ড অ্যাকশন—সবটাই তিনি ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

বাড়িওয়ালার চরিত্রে শতাব্দী ওয়াদুদ আর তাঁর স্ত্রীর চরিত্রে সুষমা সরকারও মন্দ নয়। এশার প্রেমিক তপু চরিত্রে নিবিড় আদনান ছিলেন যথাযথ। তবে নাসির চরিত্রে শরীফ সিরাজ দারুণ; তাঁর চরিত্রের মধ্যে যে খ্যাপাটে ব্যাপার ছিল, তা তিনি ভালোভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। পুলিশের চরিত্রে ফারুক আহমেদ, হাসনাত রিপন ভালো ছিলেন। বিশেষ করে ফারুক আহমেদের ‘হিসাব বরাবর’ সংলাপ বেশ উপভোগ্য ছিল।

বিশেষ চরিত্রে খুব কম সময় পর্দায় উপস্থিত থেকেও সব আলো নিজের দিকে কেড়ে নিয়েছেন সৈয়দ এজাজ আহমেদ। পর্দায় কোনো নৃশংসতা ছাড়া স্রেফ নিষ্ঠুর হাসি দিয়েই মাত করেছেন তিনি। তাঁর চরিত্র নিয়ে বেশি না বলাই ভালো, সিনেমা হলে গিয়ে চমকে যাওয়ার জন্যই বরং তুলে রাখা যাক। স্থানীয় বেকারিমালিকের চরিত্রে মিশা সওদাগর যথারীতি মানিয়ে গেছেন। তবে তাঁর কণ্ঠ অন্য কাউকে নিয়ে ডাব করানো হলো কেন বোঝা গেল না।
‘এশা মার্ডার: কর্মফল’ সিনেমার চিত্রনাট্যকার ও নির্মাতা সানী সানোয়ার পুলিশ কর্মকর্তা। আগে ‘ঢাকা অ্যাটাক’, ‘মিশন এক্সট্রিম’, ‘ব্ল্যাক ওয়ার: মিশন এক্সট্রিম ২’ সিনেমার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু বড় বাজেটের সেই ছবিগুলোকে অনায়াসে টেক্কা দিয়েছে ‘এশা মার্ডার’। এটি ধীরগতির পুলিশি তদন্তের সিনেমা; তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করার মতো। গতি ধীর হলেও চমকের কমতি নেই। এই সিনেমায় যেভাবে বিস্তারিতভাবে তদন্তপ্রক্রিয়া দেখানো হয়েছে, ঢাকাই সিনেমায় তেমনটা চোখে পড়ে না। নির্মাতার বাস্তব পেশা এ ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে।

নারীপ্রধান সিনেমা দেশে খুব একটা হয় না, আর নারীপ্রধান পুলিশি তদন্ত ধারার সিনেমা তো নেই বললেই চলে; ‘এশা মার্ডার’ তাই হয়ে রইল উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। সত্য ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত এই থ্রিলারে স্কুলে যৌন হয়রানি, পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে বার্তা দিতে চেয়েছেন নির্মাতা। ব্যাড প্যারেন্টিং কীভাবে সাধারণ যুবককে মনোবিকারগ্রস্ত মানুষে পরিণত করে, সেটাও তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তবে মনোবিকারগ্রস্ত হওয়ার যে যে কারণ এখানে দেখানো হয়েছে, সেটা আরও পরিণত হতে পারত। একইভাবে টানা কয়েক বছর ভালোবাসা দিবসের পরে নারীদের ধর্ষণ করে খুনের একটা বিষয় এসেছে, সেটারও যথাযথ ব্যাখ্যা নেই।
সিনেমার ‘বন্দী শুধু জানে মুক্ত হওয়ার মানে’ গানটিও সিনেমার মূল বিষয়বস্তুর সঙ্গে মানিয়ে গেছে। সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে আলাদাভাবে কথা বলতেই হয়। ঝাঁ–চকচকে ব্যাপার এখানে নেই। সুদীপ্ত মজুমদারের ক্যামেরা পুরো সিনেমাজুড়ে একটা ডার্ক টোন বজায় রেখেছে। এমনকি গ্রামের দৃশ্যেও সবুজের বদলে রুক্ষতা, ধুলো সিনেমার মেজাজের সঙ্গে মানিয়ে গেছে। অল্প বাজেটের মধ্যে সিনেমার ধাওয়া, অ্যাকশনের দৃশ্যও মন্দ নয়। বিশেষ করে ক্ল্যাইমেক্সে ভোরবেলা আলো-আঁধারিতে বাঁধন আর মূল খলনায়কের অ্যাকশন ছিল গায়ে কাাঁটা দেওয়ার মতো।