সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরের কালশী মোড় থেকে বাউনিয়া বাঁধ রোড ধরে যাচ্ছিলাম দেওয়ানপাড়ার দিকে। রাস্তার দুই ধারে নতুন নতুন বড় বড় দালান উঠছে আর রাস্তার ধারের ঝোপঝাড় উজাড় হচ্ছে, ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বড় কোনো গাছপালা নেই, সবুজ যেন নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে, জলাশয়ও। শেষমেশ কী আছে ঢাকা শহরের ভাগ্যে কে জানে। রাস্তার ধারে ধুলোমাখা শরীর নিয়ে কিছু লতা, বিরুৎ, তৃণ যেন উদোম মাটির সেই লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করে চলেছে। কয়েকটা আসামলতার গাছ যেন সেই আব্রু ঢাকার প্রধান অবলম্বন, সঙ্গে সঙ্গ দিচ্ছে মলিন চাপড়া, উলু ও দূর্বা ঘাস, ত্রিধারা আগাছা। কোনো গাছেই কোনো ফুল নেই। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গাছগুলোর গা পরিষ্কার হয়েছে। ত্রিধারার ওই দু-চারটা ফুলেই হয়রান হয়ে ছোটাছুটি করছে একটা প্রজাপতি। কোথাও যেন ওর আহার জুটছে না। ক্ষুধার্ত প্রজাপতি সাদাটে ত্রিধারা ফুল থেকে মধু খেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। অনবরত উড়তে উড়তে ক্ষণিকের জন্য সে ফুলে বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। অলস-ক্লান্ত ভঙ্গিতে ডানা চারটে দুই পাশে মেলে ধরে সে যেন প্রকৃতিমাতার কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছে একরত্তি আহার আর আশ্রয়ের জন্য। ঢাকা শহরে গাছ নেই, ফুল নেই, ফল নেই, পাখি নেই, প্রজাপতি নেই- এ রকম একটা দৃশ্য কল্পনা করতেও ভয় হয়। যা দু-চারটা প্রজাপতির দেখা মেলে তার জন্য যেতে হয় নগর উদ্যানগুলোয়।
এ প্রজাপতির বাংলা নাম ধূসর শিখীপর্ণ হলেও এর আরও কয়েকটি নাম আছে। কেউ কেউ বলেন ধূসরাক্ষী বা ধূসর-সোনালি চক্র প্রজাপতি। ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এর নাম চাঁদনরি। লেপিডোপ্টেরা বর্গের নিম্ফালিডি গোত্রের এ প্রজাপতির ইংরেজি নাম গ্রে প্যানজি, বৈজ্ঞানিক নাম জুনোনিয়া আটলিটিস। এ দেশে সহজে এদের সর্বত্র দেখা যায়। তবে প্রচুর বৃষ্টিপাতপ্রবণ খোলা জায়গায় এরা বিচরণ করতে বেশি পছন্দ করে। এরা উড়তে উড়তে খুব বেশি ওপরে ওঠে না, সাধারণত মাটির কাছাকাছি চলাচল করে। জলাধারের ঝোপজঙ্গলে এদের বেশি দেখা যায়। গাজীপুরে পুবাইলে জলজঙ্গলের কাব্য রিসোর্টে গত নভেম্বরেও জলাময় বিলের ধারে এদের অনেকগুলোকে উড়তে দেখেছিলাম। ধানখেতেও এরা বিচরণ করে। তালমাখনা, কেশুটি, হেলেঞ্চা, কেশরদাম, আসামলতা ইত্যাদি আগাছার ফুলে ফুলে এদের ঘুরতে দেখা যায়।
পুরুষ প্রজাপতির চেয়ে মেয়ে প্রজাপতির দেহ একটু বড়। পুরুষ প্রজাপতির মিলনের ইচ্ছা হলে সে অনুচ্চ ঝোপের ওপর ওত পেতে বসে থাকে। একটা মেয়ে প্রজাপতি দেখলে তার পিছু পিছু উড়তে থাকে। মেয়েটাকে মিলনে রাজি করাতে সে নানাভাবে তার সঙ্গে সখ্য স্থাপনের চেষ্টা করে। এরপর একসময় দুজনে মিলনে যায়। মেয়ে প্রজাপতি গাছের পাতার ওপর ডিম পাড়ে। ডিমগুলো সেখানে তিন দিন পর ফুটে বাচ্চা বের হয়, বাচ্চারা সেসব গাছের পাতা খেতে খেতে বড় হয়। বাচ্চার দেহের রং হলুদাভ-কমলা, নলাকার, মাথা কালো ও দেহজুড়ে ছোট ছোট কাঁটার মতো অঙ্গ থাকে। পূর্ণতা পেলে বাচ্চা বা কীড়ার দেহ কালচে হয়ে যায়। মাথাটা কমলা পট্টিযুক্ত কালো হয়। বাচ্চা অবস্থায় থাকে ১২ থেকে ২২ দিন। এরপর ৫ থেকে ৯ দিন শূককীট অবস্থায় থাকার পর সেখান থেকে প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসে। শূককীট বা পিউপার রং ধূসর বাদামি। ওদের জীবনচক্র শেষ হতে ২০ থেকে ৩২ দিন সময় লাগে। বাচ্চারা পাতা খায় ও প্রাপ্তবয়স্ক প্রজাপতিরা খায় ফুলের মধু। এ দেশে এদের সারা বছরই বেশ দেখা যায়, আপাতত বিলুপ্তির কোনো ঝুঁকি বা শঙ্কা নেই। এ দেশ ছাড়াও এ প্রজাপতি আছে নেপাল, ভারত, ক্যাম্বোডিয়া, দক্ষিণ চীন, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায়।