দেশের ৫২তম মহান স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবস আজ ২৬ মার্চ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ ও চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ডাক দিয়েছিলেন। এরপর ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিরা দিবসটি উদ্?যাপন করবেন। বিশ্বব্যাপী চলা করোনা মহামারির কারণে গত দুই বছর সীমিত পরিসরে এবং কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বাধীনতা দিবস উদ্?যাপন করতে হয়েছে। এ বছর করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে। তাই স্বাধীনতা দিবস উদ্?যাপনে এবার স্বতঃস্ফূর্ততা বেশি থাকবে।
বাসস জানায়, স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তাঁর বাণীতে বলেছেন, স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য অর্জনে জনমুখী ও টেকসই উন্নয়ন, সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। তিনি স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেশে ও প্রবাসে থাকা সব বাংলাদেশিকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহত করতে হবে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে দেওয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশে উন্নয়নের যে গতিধারা সৃষ্টি হয়েছে, তা অব্যাহত থাকলে বিশ্বমানচিত্রে বাংলাদেশ অচিরেই একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। দেশে এবং প্রবাসে থাকা সব বাংলাদেশিকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাশে থাকার জন্য সব বন্ধুরাষ্ট্র, সংগঠন, সংস্থা ও ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
বাসস জানায়, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস যথাযোগ্য মর্যাদায় উদ্?যাপনের লক্ষ্যে জাতীয় পর্যায়ে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এদিন ঢাকাসহ সারা দেশে প্রত্যুষে তোপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটি পালনের সূচনা হবে। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে। এ দিবসে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। বাসস আরও জানায়, স্বাধীনতা দিবস উদ্?যাপন উপলক্ষে আজ সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠন, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, তারা আজ সকাল ছয়টায় সীমিত পরিসরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন, সকাল সাতটায় ধানমন্ডি
৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন, টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন এ ছাড়া তারা সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে ঢাকার শেরেবাংলা নগরে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবর জিয়ারতসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে।
স্বাধীনতা দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্য আমাদের জাতীয় জীবনে অপরিসীম। আমাদের জাতীয় দিবস হিসেবে যতগুলাে দিন রয়েছে, স্বাধীনতা দিবস তার মধ্যে অন্যতম। এ দিনটি শুধু ঐতিহাসিক তাৎপর্যেই অসাধারণ নয়, নবীন জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার শপথে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করার দিন হিসেবেও অনন্যসাধারণ। মূলত ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঘােষিত হয় আমাদের স্বাধীনতা। এর পরপরই শুরু হয় প্রতিরােধ ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। দেশ স্বাধীন করার প্রত্যয়ে দৃঢ়চিত্ত বাঙালি জাতির ইতিহাসে এ দিনটি একটি মাইলফলক। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী বাঙালির ওপর প্রায় দুই যুগব্যাপী যে নিপীড়ন ও শােষণের সৃষ্টি করেছিল, তা থেকে মুক্তি পাওয়ার এক অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামে বাঙালি একত্র হয়েছিল এই দিনে। স্বাধীনতা দিবস অর্থাৎ ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘােষণা অকস্মাৎ সৃষ্ট কোনাে আবেগময় ঘােষণা নয়। এর পেছনে রয়েছে বাঙালির আত্মত্যাগ, আত্মবিসর্জন ও আন্দোলন-সংগ্রামের সুদীর্ঘ রক্তাক্ত পথ। এই অমসৃণ পথ পাড়ি দিয়ে এই দিনে বাঙালি জাতি আরেক রক্তাক্ত পথে চলতে শুরু করল। অতঃপর দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধ, সংগ্রাম, মৃত্যু, লাঞ্ছনা ও চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে আমরা লাভ করি বিজয়। হাতে পাই সবুজ-লালের মিশ্রণে তৈরি একটি পতাকা, একটি গর্বিত ভূখণ্ড। ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ‘৫৪-এর সাধারণ নির্বাচন, ‘৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ‘৬৬-এর ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান- এরকম অগণিত আন্দোলন সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালি জাতি যে প্রত্যাশাকে লালন করে অগ্রসর হয়েছিল, তারপর একাত্তরের রক্তাক্ত মার্চের অসহযােগ আন্দোলন পেরিয়ে ছাব্বিশে মার্চে সেই প্রত্যাশা, সেই স্বপ্ন পরিণত হয়েছিল মহান স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায়। স্বাধীনতার দৃপ্ত ঘােষণার মধ্য দিয়ে সেদিন নিপীড়িত ও বঞ্চিত বাঙালি জনগণের শােষণমুক্তির প্রত্যাশা অর্জন করেছিল এক নতুন দিক-নির্দেশনা, নতুন মাত্রা। সেদিন স্বাধীনতা সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সমস্ত জাতি একাট্টা হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র সংগ্রামে। বাঙালি ছিল শােষিত, অত্যাচারিত এবং সকল ক্ষেত্রে উপেক্ষিত। দেশের অর্থসম্পদ, চাকরির সুযােগ-সুবিধা, ব্যবসা-বাণিজ্য সবই একচেটিয়া করত পাকিস্তানিরা। স্বাধীন দেশের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি ব্রিটিশ শাসনামলের মতােই পশ্চিম পাকিস্তানের কৃপার পাত্র হয়ে পড়েছিল। এমনকি, বাঙালির মুখের ভাষা কেড়ে নিয়ে তাদের চিরদিনের মতো দাস করে দেওয়ার এক গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে পাকিস্তানে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মর্যাদা দেওয়া হয় উর্দুকে। কিন্তু বীর বাঙালি তা সহ্য করেনি—প্রতিবাদে, সংগ্রামে, আন্দোলনে নস্যাৎ করে দিয়েছিল তাদের সে ষড়যন্ত্র । অবশেষে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালির বিজয়ে শঙ্কিত পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে যে টালবাহানা শুরু করেছিল তাতেই বাঙালি বুঝতে সক্ষম হয় যে, এরা বাঙালিকে ক্ষমতায় দেখতে চায় না।
তখনই ছিড়ে যায় দুর্বল ঐক্যের রশিটা। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ ও নির্দেশে সমগ্র বাঙালি জাতি স্বাধীনতার জন্য মানসিক ও বাস্তব প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে। ২৬ মার্চ আসে সেই সুযােগ, স্বাধীনতার চূড়ান্ত ঘােষণা এবং বাঙালিদের সশস্ত্র প্রতিরােধ। তাই এদিন আমাদের জাতীয় জীবনের এক মহালগ্ন।