চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল। বিরল অগ্নিগলা (Firethroat) পাখির খোঁজে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যান্ড অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভোরে রওনা হয়ে ফটিকছড়ি বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছলাম সকাল সাড়ে ৮টায়। সেখান থেকে পূর্বপরিচিত শফিকুলের সিএনজিচালিত অটোরিকশায় মাত্র আধা ঘণ্টায় পৌঁছে গেলাম হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে। অটোরিকশা থেকে নেমে গাইড নাহিদুল ইসলামের গেস্টহাউসে নাশতা সারলাম। নাহিদুল বলল, ‘স্যার, আপনি তো এখানকার সব জায়গাই চেনেন। সোজা লেবু বাগানে চলে যান। সেখানকার ঝিরিতে বিকেলে পাখিটি গোসল করতে নামে। নিশ্চিতভাবেই দেখা পাবেন।’
ছড়ায় বিভিন্ন বাঁক পেরিয়ে একসময় লেবু বাগানে চলে এলাম। এখানে আমি ছাড়া আর কাউকে দেখছি না। লেবু বাগান রাজ গোখরার আখড়া। কাজেই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বাগানটি পার হলাম। লেবু বাগান পার হয়ে দুটি বাঁক ঘুরতেই প্রজাপতির আখড়ায় চলে এলাম। তবে গত জানুয়ারিতে এখানে যে পরিমাণ প্রজাপতি দেখেছিলাম, সে তুলনায় এবার তেমন একটা চোখে পড়ছে না, নতুন প্রজাপতি তো দূরের কথা। অথচ গত জানুয়ারি মাসে এখানেই প্রথমবারের মতো দুই প্রজাতির প্রজাপতির দেখা পেয়েছিলাম।
রোদের তেজ খুব বেশি। একটি সুন্দর ও ছায়াময় জায়গা খুঁজে পিঠের ব্যাগ থেকে ফোল্ডিং টুলটি বের করে বসে রইলাম। বসে বসে সামনের দিকটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করছি। হঠাৎই মাটিতে পাথর ও লতার ফাঁকে হলুদ-কালো-কমলার অতি সুন্দর এক পতঙ্গকে বসে থাকতে দেখলাম। দুটি ক্লিক করতেই সে উড়ে গিয়ে একটু খোলা জায়গায় বসল। এবার আরও ভালো ছবি তোলা গেল। একসময় এই প্রজাপতিটিকে কোথায় না খুঁজেছি? মৌলভীবাজারের আদমপুর ও লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, হবিগঞ্জের সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান, রাঙামাটির কাপ্তাই জাতীয় উদ্যান- সবখানেই। শেষ পর্যন্ত লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ২০১৫ সালে প্রথম ওকে দেখলাম। ওর ছবি তুললাম। এরপর বেশ কবার সাতছড়িতে ওকে দেখেছি। অনেক দিন পর হাজারিখিলে আবারও দেখে বেশ ভালো লাগল। হাজারিখিল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ছড়ায় দেখা অতি সুন্দর এই পতঙ্গটি আর কেউ নয়, এ দেশের এক বিরল ও সংকটাপন্ন প্রজাতির প্রজাপতি হলদে খঞ্জর। এটি লাঠিয়াল নামেও পরিচিত।
ইংরেজি নাম Five-bar Swordtail। প্যাপিলিওনিডি বা সোয়ালোলেজি গোত্রের প্রজাপতিটির বৈজ্ঞানিক নাম Graphium antiphates। সুদর্শন প্রজাপতিটি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স প্রভৃতি দেশেও বিস্তৃত।
হলদে খঞ্জর মাঝারি আকারের প্রজাপতি। প্রসারিত অবস্থায় ডানার দৈর্ঘ্য ৮০ থেকে ৯৫ মিলিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ দেখতে একই রকম। সামনের ডানার ওপরের ভিত্তি রং সাদা ও তার ওপর ৫টি কালো ডোরা রয়েছে। ডানার নিচটা দেখতে ওপরের মতোই, তবে কালো ডোরার মধ্যবর্তী অংশে সাদারওউপর সবুজের আভা রয়েছে। পেছনের ডানার নিচের পক্ষমূল সবুজ ও তাতে কমলা-হলদে পার্শ্বদাগ রয়েছে। ডানার মতো দেহ এবং পায়েও একই ধরনের রং ও কারুকাজ দেখা যায়। পেছনের ডানায় তলোয়ারের মতো লম্বা লেজটি সাদায় মোড়ানো কালচে-বাদামি। শুঁড় এবং চোখ গাঢ় কালো রঙের।
ওরা দেশের উত্তর-পূর্ব (সিলেট বিভাগ) ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের (চট্টগ্রাম বিভাগ) পাহাড়ি ও আর্দ্র চিরসবুজ বনের বাসিন্দা। সচরাচর একাকি থাকে, তবে জোড়ায় বা দলে দেখা যায়। বেশ দ্রুতগতিতে এবং বাহারি ঢঙে ওড়ে। সাধারণত গাছের ওপরের দিকে চক্রাকারে উড়তে থাকে। অবশ্য প্রায়ই নিচের ভেজা মাটি বা বালিতে নেমে আসতে দেখা যায়। স্ত্রীগুলো রসের খোঁজে সকাল ও বিকেলে ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ায়। পুরুষগুলোকে প্রায়ই ভেজা বালি বা স্যাঁতসেঁতে মাটিতে বসে রস চুষে খেতে দেখা যায়। এই প্রজাপতির জীবন চক্র সম্পন্ন হতে ২৫ থেকে ২৮ দিন সময় লাগে। স্ত্রী প্রজাপতি বিভিন্ন প্রজাতির অ্যান্ননা, স্বর্ণচাপা প্রভৃতি পোষক গাছের কুঁড়ি বা কচি পাতার নিচ দিকে পাতাপ্রতি একটি করে ঘিয়ে-সাদা রঙের মসৃণ ও গোলাকার ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে সাদা রঙের শূককীট বের হয় তিন থেকে চার দিনে। দুবার রূপান্তরিত হওয়ার পর শূককীটের বর্ণ হলদে-কমলা হয়ে যায় ও পঞ্চম বা শেষ রূপান্তর পর্যায়ে লালচে-বাদামি রং ধারণ করে। এরপর শূককীটটি কোনো একটি উপযুক্ত কাণ্ডের নিচ দিকে আটকে থেকে মূককীটে পরিণত হয়। হালকা সবুজ রঙের মূককীটের খোলস কেটে পূর্ণাঙ্গ হলদে খঞ্জর প্রজাপতি বের হতে প্রায় ১২ দিন সময় লাগে।
লেখক: পাখি ও বন্যপ্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ