অর্থনৈতিক প্রতিবেদক
সুন্দরবনের দুবলা চরের শুঁটকি পল্লির মৌসুম শেষ হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলেরা নিজ নিজ এলাকায় ফিরেছেন। এবার পরিবেশ ভালো থাকায় জেলেরা উপকৃত হয়েছেন। আর এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব আদায় হয়েছে। এ বছর মোট রাজস্ব আদায় হয়ছে ৬ কোটি ১৭ লাখ টাকা। লক্ষ্যমাত্রার ছিল সাড়ে ৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এ বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা বেশি রাজস্ব এসেছে। গত বছর আদায় হয়েছিল ৪ কোটি ১৮ লাখ টাকা।
সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, “দুবলার চার শুঁটকি পল্লি থেকে এ বছর ৬ কোটি ১৭ লাখ ২১ হাজার ৮৭১ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও বেশি মাছ আহরণ হওয়ায় রাজস্বের পরিমাণ বেড়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “দুবলার চরটি সুন্দরবনের একটি সংরক্ষিত এলাকা। সেটি নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে রয়েছে সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগ। জেলেরা বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ আহরণ করলেও দুবলার চরে অবস্থান করায় তাদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করে বন বিভাগ।”
বন বিভাগের তথ্য মতে, শুঁটকি মৌসুম শুরু হয়েছিল ২০২২ সালের ১ নভেম্বরে। আর শেষ হয় গত ৩১ মার্চ। এই পাঁচ মাসে সেখানে প্রায় দেড় হাজার বহরদারের অধীনে ১২ হাজার জেলে বঙ্গোপসাগর থেকে মাছ আহরণ করে। চরে এ বছরও জেলেদের থাকা ও শুঁটকি সংরক্ষণের জন্য বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে দেড় হাজার ঘর, ৬৩টি ডিপো এবং শতাধিক দোকান স্থাপন হয়।
সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে দিয়ে বয়ে যাওয়া শিবসা ও পশুর নদী একত্রিত হয়ে কুঙ্গা নামে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে মিশেছে। বঙ্গোপসাগরের সৈকত ঘেঁষা কুঙ্গা নদীর পূর্ব পাড়ের দ্বীপটি দুবলার চর নামে পরিচিত। প্রতিবছরই খুলনা অঞ্চলের জেলেরা সেখানে গিয়ে অবস্থান নিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে নানা প্রজাতির মাছ আহরণ করেন। সেই মাছ চরের রোদে শুঁটকি করে বাজারজাত করা হয়।
খুলনার পাইকগাছার জেলে জিহাদুল ইসলাম জানান, তার বহরে দুটি ট্রলার, ৪টি জাল ও ১৭ জন কর্মচারী ছিলেন। মৌসুমের শুরুতে এসব নিয়ে দুবলায় যেতে তার খরচ হয়েছিল প্রায় ১৭ লাখ টাকা। যার মধ্যে কিছু ঋণ, কিছু মহাজনদের ও কিছু সুদে নেওয়া ছিল। ১৭ জন কর্মচারীর প্রত্যেকের বেতন ছিল ৮ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া এবার জ্বালানি তেলের দামও বেশি ছিল। খাবার খরচও বেশি হয়। এ বছর মাছ কিছুটা ভালো পড়েছে। তাই প্রায় প্রত্যেকে লাভ করেছে। যারা বেশি লাভ করতে পারেননি, তাদের খুব বেশি লোকসানও হয়নি।
পাইকগাছা উপজেলার মাহমুদকাটি জেলেপল্লীর বিশ্বজিৎ বিশ্বাস জানান, আর্থিক দুরবস্থা, উন্নত প্রযুক্তির সংকট রয়েছে। তার মধ্য দিয়েও তারা সমুদ্রে যান।
নৌকা, জাল, খাবার, পানি সবকিছু মিলিয়ে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয়। যা দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে সুদে নিয়েছেন। ১০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে বছরে ১৩ লাখ টাকা দিতে হয়।
তিনি বলেন, “সাগর পারের চরগুলোয় জেলেরা শুঁটকির কাজ চলাকালে পানি সংকট ও চিকিৎসা সংকটে থাকে। প্রতিবছরই আমরা দাবি জানাই। কিন্তু সমাধান হয় না। কিন্তু রাজস্ব প্রতিবছরই বাড়ছে। জেলেরা নিরুপায়।”
রামনাথপুরের পাচু বিশ্বাস জানান, দায় দেনা মাথায় নিয়েই সাগরে যান। ফিরে এসেও দেনায় থাকেন। কিন্তু চরের সমস্যা সমাধান হয় না।
কচুয়া উপজেলার বগা গ্রামের ইউনুস শেখ বলেন, “নিষেধাজ্ঞার পর আর্থিকভাবে অনেক সমস্যার মধ্যে ছিলাম। কিন্তু এ মৌসুমে পরিবেশ ভাল থাকায় মাছ পেয়েছেন।”
বন বিভাগের দুবলার চর টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাসির উদ্দিন ঢাকা ট্রিবিউনকে বলেন, “সুন্দরবনে এখন ডাকাতের উৎপাত না থাকায় জেলেরা স্বাচ্ছন্দ্যে মাছ আহরণ করতে পারেন। মৌসুমের শুরুতে তারা এখানে এসে ঘর নির্মাণ করে ও মাছ শুকানোর জন্য মাচা তৈরি করে। এসব তৈরি করার জন্য তারা লোকালয় থেকে বাঁশ ও সুপারি গাছসহ অন্যান্য মালামাল নিয়ে আসে। তাদেরকে সুন্দরবনের কোনো গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয় না। এছাড়া কেউ যেন গোপন গাছ না কাটে, তার জন্য দৈনিক প্রত্যেকের বহরদারের চাতালে দুইবার বন বিভাগ টহল দেয়।”
তিনি আরও বলেন, “লোকালয় থেকে দুলবার চরে জেলেদের যেতে হয় পুরো সুন্দরবনের মধ্যে দিয়ে। মোংলা উপজেলা থেকে পশুর নদী হয়ে দুবলার চরের দূরত্ব প্রায় ১২০ কিলোমিটার। যেহেতু সুন্দরবন সংরক্ষিত এলাকা তাই প্রত্যেকে প্রতিবার আসা-যাওয়ার জন্য বন বিভাগের অনুমতি নিতে হয়। যাতায়াতের সময়ে নির্দিষ্ট রুটের বাইরে ট্রলার প্রবেশ করা যায় না। একইসঙ্গে মাছ বিক্রির জন্যেও দুবলা থেকে লোকালয়ে যেতে অনুমতি নিতে হয়।”
বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মুহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, “দুবলার চরের আশেপাশের এলাকাগুলো সুন্দরবনের অভ্যায়রণ্য। সেখানে যেন জেলেরা অবৈধভাবে প্রবেশ ও উৎপাত করতে না পারে, সে জন্য বন বিভাগকে কঠোর থাকতে হয়। তাই সাগর ব্যতীত দুবলার জেলেদের অন্য কোথাও মাছ আহরণ করতে দেওয়া হয় না।”
তিনি জানান, সাধারণত প্রতি কেজি মাছ আহরণের জন্য জেলেদের কাছ থেকে ১০ টাকা হারে রাজস্ব আদায় করা হয়। জেলেরা প্রতি ১৫ দিনের মধ্যে ৭ দিন সাগর থেকে মাছ আহরণ করেন। বাকি ৭ দিন সেই মাছের শুঁটকি করেন। তাই ১৫ দিন পরপর প্রত্যেকের বহরদাররের কি পরিমাণ মাছ আহরণ করলেন তার হিসাব করে রাজস্ব আদায় করা হয়।