আইন অনুযায়ী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) অনুমোদন বাধ্যতামূলক। আর আইন বিভাগ খোলার ক্ষেত্রে ইউজিসির পাশাপাশি বার কাউন্সিল থেকেও ছাড়পত্র নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে উচ্চ আদালতের। তবে এসব নিয়মের তোয়াক্কা না করে বার কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়াই দুটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে আইন বিভাগ খোলার অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন তথা ইউজিসির আগের প্রশাসন। যা নিয়ে চরম বিড়ম্বনায় পড়েছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ইউজিসির ওপর ‘দায় চাপিয়ে’ ঘুরছেন আদালতের দ্বারে।
অন্যদিকে বার কাউন্সিলের অনুমতি না থাকায় ওই বিশ্ববিদ্যালয় দুটির আইন বিভাগে অধ্যয়নরত কয়েকশ’ শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, বার কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়া এসব শিক্ষার্থীরা সনদপ্রাপ্ত আইনজীবী হিসেবে পেশাগত জীবন শুরু করতে পারবেন না। অথচ এই বিভাগের পড়ার মূল উদ্দেশ্যই হলো আইন পেশায় ক্যারিয়ার গড়া। অনিয়ম করে অনুমোদন দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় দুটি হলো— ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটি এবং জেডএনআরএফ ইউনিভার্সিটি অফ ম্যানেজম্যান্ট সায়েন্সেস।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে বার কাউন্সিলের কাউন্সিল সদস্য অ্যাডভোকেট মো. নজরুল ইসলাম খান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘বার কাউন্সিলের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ খোলার সুযোগ নেই। যদি কেউ খুলেও থাকে; আমরা তাদের রেজিস্ট্রেশন দিব না। আইনের কোনো পরীক্ষাতেও তারা বসতে পারবে না। তিনি বলেন, নিয়ম অমান্য করে কোন প্রতিষ্ঠান যদি এই বিভাগ খোলে; তবে এর প্রভাব এখনই পড়বে না। পড়বে পড়াশোনা শেষ করার পর।’ বার কাউন্সিলের অনুমোদন না থাকায় এর আগে প্রায় ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় বসতে দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।
ইউজিসি সূত্র জানা যায়, বিগত প্রশাসন চলাকালীন ২০২৪ সালের ২৯ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয় দুটিকে আইন বিভাগ খোলার অনুমোদন দেওয়া হয় এবং এরপরই তারা ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে। কিন্তু নিয়মবহির্ভূত ওই অনুমোদনের বিষয়ে পরবর্তীতে আপত্তি জানায় বর্তমান ইউজিসি কর্তৃপক্ষ। ফলস্বরূপ, ২০২৫ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি উভয় প্রতিষ্ঠানের আইন বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে চিঠি দেয় ইউজিসি। ইউজিসির ব্যাখ্যায় জানানো হয়, এক ধরনের অরাজক পরিস্থিতিতে ইউজিসির আগের প্রশাসন সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসনের সঙ্গে মিলে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে অনুমোদন দিয়েছে। অথচ ২০১৭ সালে উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী, কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে আইন বিভাগ চালু করতে হলে বার কাউন্সিলের ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট থাকা বাধ্যতামূলক। ইউজিসির একটি সূত্র জানায়, শুধু অনিয়ম বললে ভুল হবে, বড় ধরনের আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় দুটিকে আইন বিভাগ খোলার অনুমোদন দেয় তৎকালীন ইউজিসি প্রশাসন। আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি ওই সময় ইউজিসির ভেতরে-বাইরে অনেকটাই ‘ওপেন সিক্রেট’ ছিল বলে জানায় ওই সূত্রটি।
‘বার কাউন্সিলের ছাড়পত্র ছাড়া কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগ খোলার সুযোগ নেই। যদি কেউ খুলেও থাকে; আমরা তাদের রেজিস্ট্রেশন দিব না। আইনের কোনো পরীক্ষাতেও তারা বসতে পারবে না। তিনি বলেন, নিয়ম অমান্য করে কোন প্রতিষ্ঠান যদি এই বিভাগ খোলে; তবে এর প্রভাব এখনই পড়বে না। পড়বে পড়াশোনা শেষ করার পর।’- অ্যাডভোকেট মো. নজরুল ইসলাম খান, সদস্য, বার কাউন্সিল
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, আইন বিভাগের কার্যক্রম বন্ধ করার জন্য গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউজিসি থেকে চিঠি পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে আদালতে রিট করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো; যার ভিত্তিতে গত ১০ এপ্রিল আদালত ইউজিসির চিঠির ওপর ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দেন। পরে ওই স্থগিতাদেশ চ্যালেঞ্জ করে ইউজিসি পাল্টা রিট করলে ২৮ মে তা খারিজ করে দেন আদালত। ফলে বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের ভর্তি কার্যক্রম ও শ্রেণী কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ইউজিসির সচিব মো. ফখরুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘গত বছর সারাদেশে যখন আন্দোলন চলমান, তখন ইউজিসির আগের প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আইন বিভাগে ভর্তির অনুমোদন দেয়। এটি আমাদের নজরে আসে গত ফেব্রুয়ারি-মার্চের সময়ে। কারণ, এটি পরিচালনার জন্য বার কাউন্সিলের অনুমোদন লাগে।’ এসব বিষয় প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পরিচালক বিস্তারিত বলতে পারবেন বলে জানান তিনি। তবে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পরিচালক মো. সুলতান মাহমুদ ভূঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন তিনি। এ সময় ইউজিসির লিগ্যাল সেলে কথা বলার পরামর্শও দেন। যদিও লিগ্যাল সেলের প্রধান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, এটা নিয়ে কথা বলা তার কাজ নয়।
পরে সামগ্রিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সদস্য (বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘বিষয়টি আমাদের জন্য সত্যিই বিব্রতকর। এটি অতীতে ঘটে গেছে, তবে আমরা আমাদের অবস্থান থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। যারা এই অনিয়মে জড়িত, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে চাই। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করব।’ ঘটনার ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভাগগুলোকে অনুমোদন দেওয়া হয়নি। বার কাউন্সিলের অনুমোদন ছাড়াই ইউজিসি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে আইন বিভাগ খোলার অনুমতি দিয়েছিল। বিষয়টি বর্তমানে আদালতে বিবেচনাধীন রয়েছে।’
অধ্যাপক আনোয়ার আরও বলেন, ‘এটি মূলত প্রক্রিয়াগত জটিলতা। এটি ইউজিসির নিজস্ব কোনো সিদ্ধান্ত ছিল না, বরং আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী ভর্তি কার্যক্রম স্থগিত করা হয়েছিল। আমরা যে প্রক্রিয়ায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি, বিভাগগুলোকে অনুমোদন দিয়ে থাকি, তার জন্য তদন্ত প্রতিবেদন আবশ্যক— যা আমরা নতুন প্রশাসন এসে পাইনি।’ পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আদালতে রিট করলে আদালত ছয় মাসের জন্য স্থগিতাদেশ দেন। সে অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আপাতদৃষ্টিতে তাদের স্বাভাবিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে। তবে এর সমাধান হতে হবে। আদালতেই এর স্থায়ী সমাধান হবে। বার কাউন্সিলের ছাড়পত্র না থাকা এবং প্রক্রিয়াগত ত্রুটির কারণেই এ সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে।’
যা বলছে দুই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় জেডএনআরএফ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভর্তি কর্মকর্তার সঙ্গে। তিনি জানান, গত বছরের ২৯ আগস্ট আমরা অনুমতি পেয়েছি। চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি ইউজিসি আমাদের চিঠি দিয়ে আইন বিভাগ বন্ধের কথা বলেন। কিন্তু এতদিনে আমরা শিক্ষার্থী ভর্তি করিয়ে নিয়েছি। পরবর্তীতে আদালতে রিট করলে গত ১০ এপ্রিল এই চিঠিকে ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেয়। বর্তমানে আমরা আমাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। ভর্তি কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। এছাড়া ভর্তি করানোর পর আমরা বার কাউন্সিলে চিঠি দিয়ে জানিয়েছি, ইউজিসি আমাদের অনুমতি দিয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়টি বার কাউন্সিল থেকে কোনো ছাড়পত্র নেয়নি বলে জানা গেছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্ত দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, বার কাউন্সিলের ছাড়পত্র নেওয়ার কথা ছিল ইউজিসির। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন অনুমোদন দেওয়ার পর তাদের কথা ছিল তারা ছাড়পত্র নিয়ে দেবে। এজন্য রিটটা আমরা তাদের বিরুদ্ধেই করেছি। কারণ ইউজিসি বার কাউন্সিল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে অনুমোদন দেওয়ার দরকার ছিল। আর এসব ক্লিয়ারেন্সের জন্য বার কাউন্সিলের একটা নিয়ম-নীতি বানানো দরকার ছিল, কিন্তু তারা সেটা বানাইনি। এমনকি এটা এখনও নেই।
ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড ইউনিভার্সিটির রেজিস্ট্রার মো. ফাইজুল্লাহ কৌশিক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, অনভিপ্রেত কারণ দেখিয়ে আইন বিভাগের অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য ইউজিসি আমাদের একটা চিঠি দিয়েছিল। পরে আমরা বিষয়টি নিয়ে আদালতে রিট করলে আদালত এটিতে ছয় মাসের স্থগিতাদেশ দেন। বার কাউন্সিলের ছাড়পত্রের বিষয়ে তিনি বলেন, ছাড়পত্রের বিষয়ে আমরা কীভাবে জানব? এটা তারা বলতে পারবে। আমরা অনুমোদন চেয়েছি, তারা আমাদের অনুমোদন দিয়েছে। আবার বন্ধ করার কথা বলেছে। এজন্য আমরা রিট করেছি।
তিনি বলেন, হাইকোর্টের ভাষ্যমতে বার কাউন্সিলের একটা ফ্রেম দরকার। কিন্তু সেটা তাদের নেই। আবার যখন একটা প্রোগ্রাম চালু হয়ে যাবে, স্টুডেন্ট ভর্তি হয়ে যাবে তখন এই প্রোগ্রাম বন্ধ করার কোনো এখতিয়ার কারো নেই।