মনিরা হাঁসের (বৈকাল টিল) সন্ধানে ২০১৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাজশাহীর পদ্মা নদীতে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বটতলা ঘাট থেকে ছেড়ে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় আধঘণ্টায় সিমলা পার্কের উল্টো পাশের চরের কাছে আসতেই একটি ঘুঘুকে পাড়ে বসে থাকতে দেখলাম। দ্রুত একটি ছবি তুলে ওটির পরিচয় নিশ্চিত হলাম। এই দুল৴ভ পাখিটি প্রথম দেখি ২০১৪ সালের ২৭ মার্চ কুয়াশাভরা সকালে হবিগঞ্জের কালেঙ্গা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্যে। এরপর ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি সুন্দরবনের করমজলে।
পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর কাছ থেকে ভালো ছবি তোলার আশায় ধীরে ধীরে নৌকা পাখিটির কাছাকাছি নিতে থাকি। তবে নৌকা যতই কাছে যাক না কেন, সেটি কিন্তু অবিচল—একটুও নড়ছে না, চুপচাপ বসে আছে। কৌতূহলবশত নৌকা থেকে পাড়ে নামলাম, পাখিটির একদম কাছে চলে গেলাম। এরপর সেটি ধীরে ধীরে হাঁটা শুরু করল। আমরাও পিছু নিলাম। কিছুক্ষণ পর অনেকটা অনিচ্ছায় উড়াল দিল পাখিটি।
ঘুঘু পাখি কবুতরের মতো একই গোত্র কোলাম্বিডির (কপোত) সদস্য। ঘুঘুর দেহ কবুতরের মতোই তুলনামূলক ভারী, মাথা ছোট, চঞ্চু ও পা খাটো। ওড়ার পেশি শক্তিশালী। তাই দ্রুত ও দীর্ঘক্ষণ উড়তে সক্ষম। লেজ হাতপাখার মতো বিস্তৃত। তবে আকারে কবুতরের চেয়ে ছোট হয়। এরাও স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষ পিত্তথলিতে উৎপন্ন ক্ষীরের মতো অর্ধতরল দুধ খাইয়ে ছানাগুলোকে বড় করে তোলে, যা ‘পায়রা বা ঘুঘুর দুধ’ নামে পরিচিত। এদেশে এই গোত্রের যে ১৮টি প্রজাতির সন্ধান পাওয়া গেছে, তার মধ্যে ১০টি কবুতর ও ৮টি ঘুঘু রয়েছে। প্রায় অর্ধেকের বেশি প্রজাতি সারা বছর প্রজনন করে। আয়ুষ্কাল চার থেকে ছয় বছর। এখানে এ পাখির সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হলো।
রামঘুঘু (ওরিয়েন্টাল টার্টল ডাব): ফিচারের শুরুতে লালচে বাদামি বর্ণের যে ঘুঘুর গল্প বললাম, সেটি এ দেশের দুর্লভ আবাসিক পাখি রাম, কইতর বা গোলাপ ঘুঘু। বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বহু দেশে এর দেখা মেলে। প্রাপ্তবয়স্ক ঘুঘুর দেহের দৈর্ঘ্য ৩৩ থেকে ৩৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১৬৫ থেকে ২৭৪ গ্রাম।

ধবল ঘুঘু (ইউরেশিয়ান কলারড ডাব): এটি এ দেশের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক পাখি। মালা, ধইলে, কণ্ঠি, নোদা বা পাড়ঘুঘু (পশ্চিমবঙ্গ) নামেও পরিচিত। বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে দেখা যায়। গড় দৈর্ঘ্য ৩২ সেন্টিমিটার। ওজন ১২৫ থেকে ২৪০ গ্রাম।
লাল ঘুঘু (রেড টার্টল ডাব): লালচে পিঠের সচরাচর দৃশ্যমান আবাসিক ঘুঘুটি জংলা, শনি, মটর, ঘট, কল, দল বা পেঁচি ঘুঘু নামেও পরিচিত। বাংলাদেশ ছাড়া ফিলিপাইন, দক্ষিণ চীনসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়। দৈর্ঘ্য ২০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার। ওজন ১০০ থেকে ১৪০ গ্রাম।

তিলা ঘুঘু (ওয়েস্টার্ন স্পটেট ডাব): অতিপরিচিত ও বহুল দৃশ্যমান আবাসিক পাখি তিলা ঘুঘু পাতি, তেলিয়া, তিলে (পশ্চিমবঙ্গ), ছিট, বরন, পাচুরি ঘুঘু বা ডুফি বা টেডিকল নামেও পরিচিত। বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র এর বিচরণ। দৈর্ঘ্য ২৭ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার। গড় ওজন ১২০ গ্রাম।
চীনা তিলা ঘুঘু (ইস্টার্ন স্পটেড ডাব): প্রজাতিটির কোনো বাংলা নাম নেই। বৈজ্ঞানিক নামের শাব্দিক অর্থ অনুযায়ী চীনা তিলা ঘুঘু বলা যায়। সূত্রমতে, চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বনাঞ্চলে পাখিটি থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আবাসিক পাখিটির এ দেশে বর্তমান অবস্থা জানা যায়নি।

খুদে ঘুঘু (লাফিং ডাব): ছোট আকারের বিরল ঘুঘুটি এ দেশের অনিয়মিত ও ভবঘুরে পাখি। পশ্চিমবঙ্গে ছোট ঘুঘু নামে পরিচিত। এটির বিচরণ আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চল থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত। আমি দুবাই ও ভারতে দেখেছি। দৈর্ঘ্য ২৫ থেকে ২৭ সেন্টিমিটার। ওজন ৭০ থেকে ৯২ গ্রাম।
ডোরা কুলি ঘুঘু (বারড কুক্কু-ডাব): নয়নকাড়া এ পাখির কোনো বাংলাদেশি নাম নেই। অনুবাদ করে ডোরা কুলি ঘুঘু নামে ডাকা যায়। পশ্চিমবঙ্গে বলে ছিটঘুঘু। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশে ঘুঘুটি দেখা যায়। দৈর্ঘ্য ৩৫ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার। ওজন ১৫০ থেকে ১৮০ গ্রাম।
বাঁশ ঘুঘু (গ্রে-ক্যাপড এমারাল্ড ডাব): এ দেশে দৃশ্যমান আবাসিক পাখিটি সবুজ ঘুঘু নামেও পরিচিত। পাকিস্তান ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ; অর্থাৎ ভারত থেকে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও অস্ট্রেলিয়ার পূর্বাঞ্চল পর্যন্ত এ পাখির বিচরণ। দৈর্ঘ্য ২৬ থেকে ২৭ সেন্টিমিটার। ওজন ১৩০ থেকে ১৩৫ গ্রাম।
আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ