রংপুরের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙ্গা আম বাজারে আসার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেছে ‘ঢলতা’ নেওয়ার পুরোনো কৌশল। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই অনিয়মে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন আমচাষিরা। প্রশাসনের নজরদারির অভাবে অসহায় হয়ে পড়েছেন তারা। আড়তদাররা জোর করেই প্রতি মণে ৫ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত আম বেশি নিচ্ছেন। যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘ঢলতা’হাঁড়িভাঙ্গা আমের উৎপত্তিস্থল রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পদাগঞ্জ হাটকে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আমের হাট হিসেবে ধরা হয়। প্রতিদিন ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বদরগঞ্জ, মিঠাপুকুর ও রংপুর সদরের বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার মণ আম বেচাকেনা হয় এই হাটে। শুরুতে কম পরিমাণ ঢলতা নেওয়া হলেও সময়ের সঙ্গে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ থেকে ১০ কেজিতে।সম্প্রতি পদাগঞ্জ ও বদরগঞ্জ হাটে গিয়ে দেখা যায়, আড়তদাররা প্রতি মণে ৫ থেকে ১০ কেজি আম ঢলতা হিসেবে নিচ্ছেন। এ ছাড়া প্লাস্টিক ক্যারেটের ওজন হিসেবে কেটে নিচ্ছেন দেড় কেজি আম। এতে আম বেচতে গিয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা।
বদরগঞ্জের আমচাষি জুয়েল আহমেদ বলেন, ‘শুরুতে ঢলতা ছিল ৩ কেজির মতো, এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ কেজিতে। না দিতে চাইলে আড়তদাররা গায়ের জোরে নিয়ে নেন। এতে চাষিরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন।’ একই অভিযোগ করেছেন মিঠাপুকুরের আমচাষি মোন্নাফ হোসেন।
তিনি বলেন, ‘এক মণ আম বেচার সময় ৬ থেকে ৮ কেজি ঢলতা দিতে হয়। তার ওপর ঘরমালিককে দিতে হয় ১ কেজি করে। খাজনা দিয়ে শেষে কিছুই থাকে না। আমচাষিরা নিজেরা বাজারে আম নিয়ে এলেও লাভ তো হয়ই না, বরং ক্ষতি হয়।’
সদরের আমচাষি রহমত আলী বলেন, ‘এক মণ আমে যদি ৫ থেকে ৮ কেজি বেশি নেয়, আবার ক্যারেটের ওজন কেটে নেয়, তাহলে কিছুই থাকে না। অনেক বছর ধরে এই অনিয়ম চলছে। প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নেয় না।’
ব্যবসায়ীরা অবশ্য নিজেদের অবস্থান থেকে ঢলতা নেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরছেন। পদাগঞ্জ এলাকার ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাসেল আহমেদ বলেন, ‘এখানে ৪৬ কেজিতে এক মণ ধরা হয়, ক্যারেটসহ ৫০ কেজি নেওয়া হয়। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে এই কয়টা আম বেশি না নিলে সম্ভব হয় না। অনেক সময় আম পচে যায় বা পড়ে যায়, তখন ক্ষতি হয়। তাই কিছু বাড়তি নিতে হয়।’
ব্যবসায়ীদের দাবি, বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে ঢলতা নিতে হয়। পদাগঞ্জ হাটের আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক মানিক মিয়া বলেন, ‘দেশের সবখানেই এখন ৫৫ কেজির ওপর আম নেওয়া হয়। আমরা আমচাষিদের দামও বাড়িয়ে দিই। ১ কেজি আমের দাম ৩০ টাকা ধরলে ৫০ টাকা বেশি দিই। এতে চাষিদের তেমন ক্ষতি হয় না। বরং এতে ক্রেতারাও আগ্রহী হন এই হাটে আসতে।’ তবে চাষিরা বলছেন ভিন্ন কথা। পদাগঞ্জ হাটে আম আনার আগে একটু স্বস্তি পেলেও বিক্রির পর ফিরে যেতে হয় হতাশা নিয়ে। ঢলতা ও ক্যারেটের ওজন মিলিয়ে প্রতি মণে ১০ কেজি পর্যন্ত আম কমে গেলে লাভ তো হয়ই না, বরং উৎপাদন খরচই ওঠে না।
এ বিষয়ে মিঠাপুকুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমি সদ্য যোগদান করেছি। বিষয়টি বিস্তারিত জানা নেই। কোথায় কাকে বললে বন্ধ হবে, সেটা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রবিউল ফয়সাল জানান, গত মঙ্গলবার পদাগঞ্জসহ আশপাশের মোকামগুলোতে প্রতি মণ বড় আকারের কাঁচা হাঁড়িভাঙ্গা আম ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকা, মাঝারি সাইজের কাঁচা আম ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ টাকা এবং পাকা আম ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।