বৈজ্ঞানিক গবেষণায় উঠে এসেছে, মানুষের অন্ত্রে থাকা একটি সাধারণ ব্যাকটেরিয়া প্লাস্টিক বর্জ্যকে প্যারাসিটামল-জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধে রূপান্তর করতে পারে। এ বিষয়ে সম্প্রতি একটি গবেষণা নেচার কেমিস্ট্রি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, এই পদ্ধতি ভবিষ্যতে পরিবেশবান্ধব রিসাইক্লিং প্রযুক্তির ভিত্তি গড়ে তুলতে পারে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
ক্ষুদ্র আকারের প্লাস্টিক কণাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক বলা হয়। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক শরীরে প্রবেশ করে হরমোনজনিত সমস্যাসহ ক্যানসারের মতো জটিল রোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয়। ফলে প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে বৈশ্বিক উদ্বেগ বাড়ছে। এই সমস্যা মোকাবিলায় বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে প্লাস্টিক বর্জ্য টেকসইভাবে পুনর্ব্যবহারের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন। পরীক্ষিত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে কাঙ্ক্ষিত ক্ষুদ্র অণু তৈরির জন্য ব্যাকটেরিয়া ও তাদের এনজাইমের ব্যবহার বিশেষভাবে আশাব্যঞ্জক ফল দিয়েছে।
ব্যাকটেরিয়ার রসায়ন
বিজ্ঞানীরা জানান, অণুজীবের মধ্যে থাকা ‘টুলবক্স’-এ অত্যন্ত সক্রিয় রাসায়নিক উপাদান রয়েছে, যা রাসায়নিক প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন জৈব যৌগ তৈরি করতে পারে।বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, বিভিন্ন শিল্পে প্রয়োজনীয় ছোট অণু উৎপাদনে এই রাসায়নিকগুলো ব্যবহার করা যাবে। অণুজীব ও তাদের বিপাকীয় রাসায়নিক উপাদানগুলো বিভিন্ন শিল্পে ব্যবহার করলে, বর্তমানে প্রচলিত রাসায়নিক উৎপাদন পদ্ধতির ওপর জীবাশ্ম জ্বালানির নির্ভরতা কমানো সম্ভব হবে।
ই. কোলাই দিয়ে প্যারাসিটামল উৎপাদন
গবেষণায় ব্যবহৃত হয়েছে ই. কোলাই (E. coli) নামের ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত মূত্রনালির সংক্রমণ বা গ্যাস্ট্রিক সমস্যার জন্য পরিচিত। গবেষকরা দেখেছেন, এই ব্যাকটেরিয়ার কোষে থাকা ফসফেট একটি নির্দিষ্ট রাসায়নিক বিক্রিয়াকে সক্রিয় করে, যা ‘লসেন রি-অ্যারেঞ্জমেন্ট’ বা ‘লসেন পুনর্গঠন’ নামে পরিচিত। এই প্রক্রিয়ায় নাইট্রোজেনযুক্ত জৈব যৌগ উৎপাদিত হয়, যা কোষের বিপাকে অপরিহার্য।
বিজ্ঞানীরা ব্যাখ্যা করেছেন, ‘এই বিক্রিয়াটি জীবন্ত অবস্থায় স্বাভাবিক পরিবেশে ঘটে, যা ই. কোলাইয়ের জন্য অবিষাক্ত এবং কোষের মধ্যে থাকা ফসফেট দ্বারা অনুঘটিত হয়।’
গবেষকরা পলিইথিলিন টেরেফথ্যালেট (পিইটি) প্লাস্টিকের বোতল পচানোর পরিবর্তে ভাঙার জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন। এতে লসেন পুনর্গঠন রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক অণু তৈরি করা যায়। তারা দেখিয়েছেন, কোষের ভেতরের বিপাক প্রক্রিয়া এর পিইটি-কে পুনরুদ্ধার করতে পারে।
গবেষকরা জানিয়েছেন, এই প্লাস্টিক থেকে প্রাপ্ত অণু ই. কোলাইয়ের মধ্যে প্যারাসিটামল উৎপাদনের জন্য প্রাথমিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে, যার উৎপাদন হার ছিল ৯২ শতাংশ। এটি প্রথম ঘটনা, যেখানে বর্জ্য পদার্থ ব্যবহার করে ই. কোলাই থেকে প্যারাসিটামল তৈরি করা হয়েছে।
গবেষণা নিবন্ধে বলা হয়েছে, এই পদ্ধতি প্লাস্টিক বর্জ্য বাণিজ্যিকভাবে কাজে লাগানোর একটি সম্ভাব্য কৌশল তৈরি করেছে। ভবিষ্যতে আরও নানা প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া ও প্লাস্টিক থেকে বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ রাসায়নিক উৎপাদন সম্ভব হতে পারে।
গবেষকরা মনে করছেন, এই উদ্ভাবন পরিবেশ সুরক্ষা ও ওষুধ উৎপাদনে একযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। তারা আরও জানিয়েছেন, এই গবেষণা ‘স্মল মলিকিউল সিনথেসিস’ বা ক্ষুদ্র জৈব যৌগ তৈরির ক্ষেত্রে মেটাবলিক কেমিস্ট্রির নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। সূত্র: দ্য ইনডিপেনডেন্ট